‘গত ২২ জুন ভোরে আমাদের বন্দরের নতুন বাসায় আসে পুলিশ।
তাদের সঙ্গে ছিল মুসার বন্ধু নবী। তখন মুসা বাসায় ছিল না। কোথায় আছে জানতে
চাইলে আমি বলি জানি না। তখন পুলিশ কর্মকর্তারা আমার ফোনটি নিয়ে নেয়। ওই
ফোন দিয়ে নবী ফোন করে মুসাকে। বলে আমরা ঝামেলায় আছি তুই তাড়াতাড়ি তোর বাসায়
আয়। কিছুক্ষণ পর মুসা বাসায় আসে। এরপর পুলিশ কর্মকর্তারা নবী ও মুসাকে
নিয়ে চলে যায়। এরপর তার আর কোন খোঁজ নেই। আমরা জানি সে পুলিশ হেফাজতে আছে,
তাই অন্য কোথাও তাকে আমরা খুঁজিনি।’- ইত্তেফাক।
গতকাল বুধবার এ কথা
বলেন পুলিশের সোর্স মুসার স্ত্রী পান্না আক্তার। এখন প্রশ্ন উঠেছে, মুসা
তাহলে কোথায়? কারণ এই মুসাকে ঘিরেই আটকে রয়েছে দেশের এই মুহূর্তে সবচেয়ে
আলোচিত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার রহস্য।
ঘটনার ২৫ দিন পরও ধরাছোঁয়ার বাইরে মিতু হত্যার এই মূল সমন্বয়ক। তবে পুলিশ
বলছে, মুসাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। কিন্তু তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
পুলিশের এমন বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন মুসার স্ত্রী পান্না আক্তার।
তার ধারণা, এই হত্যার মূল হোতাকে বাঁচাতে মুসাকে গুম করা হয়েছে।
এদিকে মিতু হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন পাঁচজনের দেশ ছাড়ার উপর নিষেধাজ্ঞা
দিয়েছে পুলিশ। এরা হলেন- মুসা, রাশেদ, নবী, শাজাহান ও কালু। গতকাল
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) পক্ষ থেকে এ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বাংলাদেশের
সব স্থল ও বিমানবন্দরে বার্তা পাঠানো হয়। পুলিশ বলছে, মিতু হত্যাকাণ্ডে
এরা সরাসরি জড়িত ছিলো।
মুসার পরিবারের সদস্যরা বলছেন, মুসা ও তার বড় ভাই সাইদুর রহমান সিকদারকে
পুলিশ গ্রেফতার করেছে। মুসার সঙ্গে তাদের আর কোনো যোগাযোগ নেই। মুসা পুলিশ
হেফাজতে রয়েছেন, এমনটা জেনেই তারা কোনো আইনি পদক্ষেপও নেননি। তারা জানান,
মুসার মুখোমুখি করতেই বাবুল আক্তারকে গত শুক্রবার গভীর রাতে পুলিশ তার
ঢাকার শ্বশুরের বাসা থেকে নিয়ে যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন
কামাল শনিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমকে জানান, মিতু হত্যার কয়েকজন
আসামির মুখোমুখি করার জন্য বাবুল আক্তারকে আনা হয়েছে। তবে গতকাল পর্যন্ত
তিনি বলেননি ওই আসামি কারা ছিল। সঙ্গত কারণেই মানুষ ধরে নিয়েছে ওই আসামিদের
মধ্যে মুসাও ছিল। অথচ পুলিশ দাবি করছে মুসাকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না।
পুলিশের এই দাবি যদি সত্যও হয়, তাহলে মুসা কোথায় গেল? এটাই এখন মিলিয়ন
ডলারের প্রশ্ন! পুলিশ ছাড়াও কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা মিতু হত্যার তদন্তে
নিয়োজিত। গত এক সপ্তাহ তাদের কারো কাছ থেকেই মুসাকে হেফাজতে নেয়ার বিষয়টি
নিশ্চিত করা যায়নি। স্বাভাবিক কারণেই সাধারণ মানুষ এখন ভাবতে বাধ্য হচ্ছে
যে মুসাকে কি তাহলে গুম করা হয়েছে! মিতু হত্যার নেপথ্য কুশীলবকে আড়াল করতেই
কি মুসাকে গুম করা হলো! প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করে মুসাকেই কি বলির পাঁঠা
বানানো হচ্ছে। এমন অনেক প্রশ্ন থাকলেও কোনটিরই উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার গতকাল বলেন, মিতু হত্যাকাণ্ডের ‘মূল জায়গা’
হলো মুসা। তাকে ধরার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। মুসার পরিবারের দাবি
সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘একটা মানুষ এক সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ। তাকে যদি কেউ ধরে
নিয়ে থাকে তাহলে প্রেসের মাধ্যমে তা প্রকাশ করার সুযোগ ছিল। পরিবারের উচিত
ছিল এ বিষয়ে থানায় জিডি করা বা আমাদের নলেজে নিয়ে আসা। কিন্তু তারা সেটা
করেননি।’
মুসাকে ঢাকায় বাবুল আক্তারের মুখোমুখি করা হয়েছিল কিনা- এমন প্রশ্নের
উত্তরে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। কাদের মুখোমুখি করা
হয়েছে বা করা হয়নি তা আমার জানা নেই। মুখোমুখি করার কথা মাননীয় মন্ত্রী
মহোদয় বলেছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘সংবাদ প্রচারের জন্য আপনারা (গণমাধ্যম)
যেভাবে মরিয়া হয়েছেন সেটা ঠিক নয়। আপনারাই যদি সমস্ত কিছু বিশ্লেষণ করতে
থাকেন তাহলে কিন্তু তদন্ত হয় না।’
মুসার স্ত্রী’র বক্তব্য: মুসার স্ত্রী পান্না আক্তার
জানান, পুলিশ গত ১২ জুন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় মুসার বাড়িতে
অভিযান চালায়। এ সময় মুসার তিন ভাইকে আটক করে নিয়ে যায়। পরদিন ভাইদের নিয়ে
নগরীর কালামিয়া বাজার এলাকায় মুসার বাসায় অভিযান চালায়। তবে ইতিমধ্যে তারা
বাসা পরিবর্তন করে ফেলায় মুসাকে ওই বাসায় পাওয়া যায়নি। পরে মুসার বন্ধুর
নবীর কাছ থেকে তথ্য নিয়ে গত ২২ জুন ভোরে বন্দর এলাকায় মুসার নতুন বাসায়
অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় মুসা বাসায় ছিলেন না। পরে পান্না আক্তারের
মোবাইল ব্যবহার করে নবীকে দিয়ে মুসাকে ফোন করায় পুলিশ। ফোন পেয়ে মুসা বাসায়
আসে। এরপর সেখান থেকে মুসাকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়।
ভিডিও ফুটেজ দেখেও মুসাকে চিনতে পারেনি পুলিশ : মিতু
খুন হওয়ার পরপরই তিন খুনির মোটরসাইকেলে চলে যাওয়ার দৃশ্য ভিডিও ফুটেজে দেখা
গেছে। আটক একজনের জবানবন্দিতে জানা গেছে, এই তিনজন ছিল মুসা, ওয়াসিম ও
নবী। এর মধ্যে মুসা ছিল পুলিশের সোর্স। বাবুল আক্তারের সোর্স হিসেবে
দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে মুসা। এই সুবাদে সিএমপিতে তার নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল।
চট্টগ্রামের অনেক পুলিশ কর্মকর্তাই মুসাকে ভালোভাবে চেনার কথা। কিন্তু
মিতু খুনের ভিডিও ফুটেজ দেখার পরও এসব কর্মকর্তা কেন মুসাকে শনাক্ত করতে
পারলেন না, সেটা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এমনকি বাবুল আক্তারও ভিডিও
ফুটেজ দেখে দীর্ঘদিনের পরিচিত মুসাকে চিনতে পারলেন না কেন, সেটা নিয়েও
প্রশ্ন উঠেছে। তাহলে কি চিনতে পেরেও মুসাকে তারা নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার
সুযোগ দিয়েছিলেন?
পাঁচজনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা : সিএমপি কমিশনার ইকবাল
বাহার বলেন, ‘পাঁচজন যাতে দেশের বাইরে যেতে না পারে, সে জন্য স্থল ও
বিমানবন্দরগুলোকে পুলিশের তরফ থেকে জানানো হয়েছে।’ মিতু হত্যাকাণ্ডে
‘সরাসরি জড়িত’ মোতালেব মিয়া ওয়াসিম ও আনোয়ার হোসেনের আদালতে দেওয়া
জবানবন্দিতে এই পাঁচজনের সংশ্লিষ্টতার কথা এসেছে। ওয়াসিম ও আনোয়ারকে গত
শনিবার গ্রেফতারের পর সিএমপি কমিশনার বলেছিলেন, ‘জিইসি মোড়ের কাছে মিতু
হত্যাকাণ্ডে সাত-আটজন অংশ নিয়েছিল। এদের মধ্যে ওয়াসিম গুলি চালান, আনোয়ার
অনুসরণকারী ছিলেন।’ পরে তাদের জবানবন্দির ভিত্তিতে ওই হামলার ‘অস্ত্র
জোগানদাতা’ এহতেশামুল হক ভোলা ও মনির হোসেন নামে দু’জনকে গত মঙ্গলবার
গ্রেফতারের কথা জানায় পুলিশ।
প্রসঙ্গত, গত ৫ জুন চট্টগ্রাম শহরের জিইসি মোড়ে মাহমুদা খানম মিতুকে
কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেফতার ও
স্বামী এসপি বাবুল আক্তারকে ১৫ ঘন্টা নিজেদের হেফাজতে নিয়ে পুলিশ
‘জিজ্ঞাসাবাদ’ করলেও খুনের মূল নির্দেশদাতার পরিচয় এখনো জানা যায়নি।