শিরোনাম

সোমবার, ২০ জুন, ২০১৬

কে ছিল ফাহিম? কী ছিল তার টার্গেট?

ধারাবাহিক গুপ্তহত্যা আর জঙ্গি হামলার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান চলার মধ্যেই হিন্দু সম্প্রদায়ের এক কলেজশিক্ষককে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা চালায় কয়েকজন তরুণ। এর মধ্যে ছিলেন ফাহিম নামের এক কলেজছাত্র। কিন্তু কিলিং মিশন শেষ করার আগেই আশপাশের লোকজন ঘটনা জেনে যাওয়ায় পালানোর আগেই আটক হন জনতার হাতে।
তবে শেষ রক্ষা হয়নি আটক তরুণটির। ঘটনায় জড়িত অন্যদের ধরতে তাকে নিয়ে অভিযানকালে শুক্রবার (১৮ জুন) ভোরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান কলেজছাত্র ফাহিম। এ নিয়ে দেশজুড়ে শুরু হয় তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। একজন তরতাজা যুবকের বিপথে যাওয়ার রহস্য জানার আগেই ক্রসফায়ারে নিহত হতে হয়েছে তাকে।
কে ছিল ফাহিম: দেশে প্রথমবারের মতো ব্যর্থ জঙ্গি হামলার পর জনতার হাতে আটক হওয়া ওই তরুণের পুরো নাম গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম (২০)। গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। তবে দীর্ঘদিন ধরেই বাবা-মার সঙ্গে বসবাস করতেন ঢাকায়। বাবা গোলাম ফারুক একজন ব্যবসায়ী আর মা সাধারণ একজন গৃহিনী।
ঢাকার উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজে এইচএসসির মেধাবী ছাত্র ছিলেন ফাহিম। এসএসসিতে পেয়েছিলেন জিপিএ-৫। কলেজে ওঠার পরেই এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে হয় পরিচয়। সেই বড় ভাইয়ের হাত ধরেই পা বাড়ান অন্য এক জগতে। কলেজের সামনে এক লাইব্রেরিতে প্রায় প্রতিদিনই তাদের বৈঠক চলতো।এর মধ্যেই সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীর সঙ্গে। তবে বাবা গোলাম ফারুক বা পরিবারের অন্য কেউ-ই জানতে পারেননি ছেলের জঙ্গি সংশ্লিষ্টার কথা। ধর্মীয় বই-পুস্তক নিয়ে ছেলের ঘাঁটা-ঘাঁটি করার অভ্যাস সম্পর্কেই জানতেন তারা।
সূত্রমতে, হিযবুত তাহরীরে জড়িয়ে পড়ার পর ফাহিমের প্রথম অপারেশনই ছিল মাদারীপুর সরকারি নাজিমউদ্দিন কলেজের গণিত বিভাগের প্রভাষক রিপন চক্রবর্তীকে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া।
প্রথম অপারেশন: প্রথম অপারেশনে অংশ নিতেই কয়েকদিন আগে বাসা থেকে বের হয়ে আসেন ফাহিম। এরপর বাবার মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়ে বলেন, ‘বিদেশ চলে গেলাম। এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। বেঁচে থাকলে আবারো দেখা হবে।’ এসএমএস পাওয়ার পরে বাবা গোলাম ফারুক রাজধানীর দক্ষিণখান থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডিতে গত ১১ জুন সকালের পর থেকে ফাহিম নিখোঁজ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
জীবনের প্রথম কিলিং মিশনেই ব্যর্থ: বুধবার (১৫ জুন) বিকেলে মাদারীপুর সরকারি নাজিমউদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্রী হোস্টেলের সামনে প্রভাষক রিপন চক্রবর্তীর ভাড়া বাসায় হাজির হন ফাহিমসহ কিলিং মিশনে অংশ নেয়া তিন তরুণ। শিক্ষককে তার নিজ বাসার মধ্যেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপর্যুপরি কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। এসময় শিক্ষকের আর্ত চিৎকারে আশপাশের মানুষ ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। অবস্থা বেগতিক দেখে হামলাকারীরা পালিয়ে গেলেও জনতার হাতে ধরা পড়ে একমাত্র ফাহিম। স্থানীয়রা তাকে তুলে দেয় পুলিশের হাতে।
মামলা দায়ের: ঘটনার পরে গুরুতর আহতাবস্থায় শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করতে কেউ এগিয়ে না আসায় একদিন পর ১৬ জুন রাতে পুলিশের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করা হয়। আটক ফাহিমের দেয়া তথমতে, মামলায় আসামি করা হয় সালমান তাসকিন সালিম (১৯), শাহরিয়ার হাসান পলাশ (২২), জাহিন (২৩), রায়হান (২৪) ও মেজবাহকে (২৪)।
‘সফট টার্গেট’: সারাদেশে হিযবুত তাহরীরের অস্তিত্ব ও কার্যক্রম জাহির করাই ছিল প্রভাষক রিপন চক্রবর্তীকে হত্যার মূল উদ্দেশ্য। তাদের এ মিশনের নামও দেয়া হয়েছে ‘সফট টার্গেট’। এর মূল কথা হচ্ছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ করার কোনো ক্ষমতা নেই, যারা সমাজে শ্রদ্ধাভাজন অথচ নিরীহ এবং ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত তাদের হত্যা করো। কেননা, এদের হত্যা করলে পাল্টা আক্রমণ আসবে না। সংগঠনের শক্তি জানান দেয়ার ক্ষেত্রে নিরাপরাধ ভালো মানুষকে সফট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই এ কিলিং মিশনকে তারা নাম দিয়েছে ‘সফট টার্গেট’।
কী ছিল ফাহিমের টার্গেট: গত ১৪ জুন ঘটনার আগেই মাদারীপুরে চলে আসেন ফাহিম। অনুসরণ করতে থাকেন শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে। ফাহিমসহ অন্য যুবকদের উদ্দেশ্য ছিল মাদারীপুরের মিশন সফলতার সঙ্গে শেষ করে তারা চলে যাবেন দক্ষিণাঞ্চলে। উপকূলীয় আরো ১০ জেলায় ‘সফট টার্গেট’ অনুযায়ী কাজ করার পরিকল্পনা ছিল তাদের।
কেন এ পথে আসা: হত্যাকাণ্ডের পর জনতার হাতে আটক হওয়া ফাহিমকে সোপর্দ করা হয়েছিল পুলিশের হাতে। বৃহস্পতিবার রাতে মামলা দায়েরের পর শুক্রবার (১৭ জুন) বিকেলেই ফাহিমকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের কাছে আবেদন জানান পুলিশ কর্মকর্তারা। আদালতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পুলিশি রিমান্ডে ফাহিম প্রথমে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী প্রথমে পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় নিষ্ফল অভিযানও চালায়।
এক পর্যায়ে ফাহিম পুলিশের কাছে স্বীকার করেন, তিনি হিযবুত তাহরীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে কেন আর কী কারণে মেধাবী এই ছাত্র জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়ে পড়লেন, কেনই বা সফট টার্গেটের মতো জঘণ্য অপরাধে আগ্রহী হয়ে উঠলেন- সে সম্পর্কে বেশি বলেননি তিনি। সেসব কথা শোনার জন্য চেষ্টা অব্যাহত ছিল পুলিশের। কিন্তু অজানা সেসব কথা জানার আগেই ক্রসফায়ারে তার মৃত্যু হয়েছে।
ক্রসফায়ার: রিমান্ডে নেয়ার দ্বিতীয় দিনে (১৭ জুন) দিবাগত ভোরে ফাহিমের দেয়া তথ্য অনুযায়ী তাকে নিয়ে অভিযানে বের হয় পুলিশ। মাদারীপুর জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) কামরুল হাসানের নেতৃত্বে ২০ জন ফোর্সের দুটি টিম ওই অভিযান পরিচালনা করেন। জঙ্গিদের ধরতে জেলা সদর থেকে অন্তত ২০ কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত বাহাদুরপুর ইউনিয়নের মিয়ারচর এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয় ফাহিমকে।
মাদারীপুর থেকে বাহাদুরপুরের মূল সড়ক পার হয়ে কাঁচা-পাকা সড়ক ধরে একটু এগিয়ে যেতেই পুলিশের ওপর অতর্কিত গুলি চালায় ফাহিমের সহযোগিরা। এ সময় পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। দুই পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় ফাহিম গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
মিয়ারচর গ্রামবাসীর দেয়া তথ্যমতে, ধান ও পাট ক্ষেতের মাঝামাঝি জায়গায় ফাহিমের লাশ পড়ে থাকতে দেখতে পান তারা। লাশের বুকে গুলির চিহ্ন ছিল। হাতে ছিল হ্যান্ডকাপ পরানো। অভিযান পরিচালনাকারী ডিবির এসআই কামরুল হাসান জানান, ঘটনাস্থল থেকে একটি বন্দুক, তিনটি গুলি ও ছয়টি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে।
মাদারীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউল মোর্শেদ বলেছেন, ‘বন্দুকযুদ্ধে নিহত ফাহিমের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডে জড়িত বাকিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সুত্র-আমাদের সময়
 
সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত © ২০২৩ বাংলা তরঙ্গ ডিজাইন বাংলা তরঙ্গ